Wednesday, June 29, 2011

নিজের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বার্থপরতা

আম্মু, ভাইয়া আমার পেন্সিল নিয়ে গেছে। ছোট্ট শিশুর এই অভিযোগ শুনলে এখন থেকে ১৫ বছর আগের একজন মায়ের অভিব্যক্তি হতো অনেকটা এরকম: তাই? দাঁড়াও আজকে ভাইয়াকে দেখাচ্ছি মজা, আমার ছোট্ট মনিটার পেন্সিল নিয়ে যায় কত বড় সাহস!! তখন বড় ছেলেকে রিকোয়েস্ট করে পিচ্চি মেয়েটার কাছে আবার তার পেন্সিল ফেরত দেয়া। কিন্তু ঠিক এই ২০১১ সালের একটি সন্ধ্যায় যদি এমনই অভিযোগ কোন পিচ্চি মেয়ে তোলে তাহলে তাকে যা শুনতে হয় তা হচ্ছে: মামনি, আম্মু টিভি দেখছি, এখন যাও, পড়তে বসো, পড়ে শুনবো। আর যদি মেয়েটি আরেকটু ঘ্যান ঘ্যান করে তখন তুমুল ঝাড়ি, দেখছোনা বেয়াদব মেয়ে, আমি টিভি দেখছি, এখন কেন ডিস্টার্ব করছ? যাও বুয়াকে গিয়ে বল।

দুটোই একটি মায়ের চরিত্র। ২০১১ সালের মায়ের চেয়ে ১৯৯৫ সালের মায়ের সন্তানের প্রতি দরদ খুব যে বেশি ছিল তা কিন্তু নয়। বরং সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা যুগের পর যুগ অপরিবর্তিত ভাবেই থাকবে। কেবল ধরনটা একটু চেঞ্জ হচ্ছে। এবার আসুন আমরা মায়ের সেই বক্তব্যটির একটু পর্যালোচনা করি। “ দেখছোনা বেয়াদব মেয়ে?” কেবল এই একটি  বাক্যই মা সম্পর্কে শিশুর শ্রদ্ধাবোধ উঠিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট, কেননা একটি শিশু মাকেই পৃথিবীতে তার সকল আবদার অভিযোগের একমাত্র কেন্দ্র মনে করে। কিন্তু যখন সে সেখানেও তার মনের ব্যথা বা আকুলতা প্রকাশ করতে পারছেনা তখন? দেখুন, পেন্সিল নিয়ে যাওয়া বিষয়টি আমাদের মত বড়দের কাছে একটি তুচ্ছ ঘটনা। কিন্তু চাইল্ড সাইকোলজিতে তার কাছে ওটাই অনেক বড় একটি ব্যাপার। আমার এখনো মনে পড়ে ছোট বেলায় একটি কলমের গায়ের ডিজাইন হাতের ঘর্ষণে উঠে যাবে বলে স্কচ টেপ পেঁচাতে চেয়েছিলাম। আমার এক স্যার বললেন তুমি ঠিক ভাবে পেঁচাতে পারবেনা, আমার কাছে দাও। আমি তার কাছে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম, কিন্তু দেখলাম পেঁচাতে গিয়ে উনি ভ্যাজাল বাঁধিয়ে টেপটাকে আবার উঠিয়ে লাগাতে নিচ্ছিলেন, আর আমার সাথের সব ডিজাইন টেপের আঠার সাথে লেগে উঠে যাচ্ছিলো। এবং এই বেদনা আমি অনেকদিন পর্যন্ত মনে রেখেছিলাম। এখন সেসব মনে পড়লে হাসি আসে, কিন্তু গভীর ভাবে ভাবলে বুঝি ওটাই তখন আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে অনেক বড় একটি যায়গা দখল করে ছিল।

এবারে যদি সেই মায়ের “আমি টিভি দেখছি” কথাটিকে পর্যালোচনা করি তাহলে কিছু ভয়ংকর বিষয় আমাদের চোখের সামনে চলে আসবে। যারা তা সহ্য করার ক্ষমতা রাখেননা তাদেরকে এক্ষুণি চোখ বন্ধ করে সড়ে পড়ার অনুরোধ করবো। কারণ যারা এই লেখাটি পড়ছেন তারা না হলেও তাদের খুব কাছের অনেক স্বজনেরাই এভাবে টিভির প্রতি আসক্ত। আমাদের সন্তানেরা ড্রাগে আসক্ত হলে আমরা প্রচণ্ড রেগে যাই কিংবা তাকে তুচ্ছ নগণ্য হিসেবে গণ্য করি। কিন্তু আমার কাছে টিভিতে আসক্তির চেয়ে ড্রাগে আসক্ত হওয়াই বেশি কল্যাণকর মনে হয়। কারণ ড্রাগতো কেবল শরীরটাকে ধ্বংস করে যদিও মনে এর কিছুটা প্রভাব পড়ে, কিন্তু টিভি আসক্তি মন মগজ মেধা এমনকি শরীরকেও একই সাথে ধ্বংস করে দেয়। আবার দেখুন, ড্রাগ আসলে কোন খারাপ কিছু নয় বরং জীবন রক্ষাকারী একটি উপাদান। কিন্তু এর ব্যাবহারিক মাত্রা এর উপযোগিতাকে অতিক্রম করলেই তা প্রাণনাশ। ঠিক তেমনি টিভি একটি চরম উপকারী বিষয় কিন্তু এর প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক মাত্রা যদি উপযোগিতাকে অতিক্রম করে বসে তখনই পারিপার্শ্বিক জগতের জন্য ভয়াবহ হুমকি ডেকে আনে। আমরা যদি তাকাই সেই দিকে, অর্থাৎ আমাদের আলোচনার “মা” কি এতো মহা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখছ যে তার সন্তানকে সেই অনুষ্ঠানের জন্য ঝাড়ি খেতে হচ্ছে? মহান সিরিয়াল। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এইসব ধারাবাহিকে মানব জীবনের জন্য মহা উপকারী পাঠ প্রদান করা হয়। যেমন এগুলোতে আপনি খুঁজে পাবেন পরকীয়া করার চমৎকার চমৎকার সব উপায়। এবং কুটনামী এবং প্যাঁচ লাগানোর যতসব আধুনিক পন্থা, সংসারে সাক্ষাত ঝামেলা পাকানোর আধুনিকতর রেসিপি। পরনিন্দা ও পরচর্চা করার খুব উন্নত প্রশিক্ষণ। আমরা ভাবছি এসব দেখে আমাদের খুব তো ক্ষতি হচ্ছেনা, বরং বিনোদন হিসেবে একাকী সময় কাটানোর মহতী উদ্যোগ। কিন্তু ক্ষতি কতটুকু হচ্ছে তা রিসেন্ট পত্র পত্রিকা খুললেও পরিষ্কার হয়ে যায়। যদিও পত্রিকার খবরে ঈমান রাখার কোন জরুরত নেই কেননা বিক্রি বাড়াতে এরা আজ একরকম তো কালই আরেকরকম সংবাদ ছাপাতে কুণ্ঠা বোধ করেনা, কিন্তু এইসব ঘটনা যে ঘটছে তা তো সত্য। খবরের কাগজে রিপোর্ট হচ্ছে মাত্র দু/একটির বাকি শত শত ঘটনা প্রতিদিন লোকলজ্জার ভয়ে আমরা চাঁপা দিয়ে বুক ভরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাটিয়ে দেই ঘুমহীন রাতগুলো। আর প্রতিদিনই ধোঁকা দিয়ে চলছি নিজেই নিজেকে।

এখন যদি আমরা বলি যে মায়ের পরবর্তী বাক্য “ এখন কেন ডিস্টার্ব করছ?” এটা চরম অমানবিক তাহলে কি আমাকে খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে? একটি শিশু প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তার মায়ের কাছেই ছুটে যাবে, তার সকল আকুতি কিংবা আনন্দানুভূতি তার মাকেই বলবে- এটাই তো নিয়ম তাই না? কিন্তু যখন সে তার মায়ের কাছ থেকে তা না পায় তাহলে আমরা কি করে আশা করবো মায়ের শিশুকালে (বার্ধক্যে মানুষ আবার শিশু হয়ে যায়) সে পরম যত্নে টেক কেয়ার করবে? আমাদের এইসব কর্মকাণ্ডই আমাদেরকে এমন একটি পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে মায়া মমতা ও ভালোবাসা বলে কিছু থাকবেনা, মানুষ কেবল রবোটিক একটি জীবনে অভ্যস্ত থাকবে। আর হাসি আনন্দের জন্য ভাঁড় এবং টিভিতে কৌতুক আইডলের প্রোগ্রাম করে জীবনকে সামান্য রসাত্মক করার প্রচেষ্টা চলবে।

মায়ের শেষ বাক্যটি কি ছিল মনে পড়ছে? “যাও বুয়াকে গিয়ে বল” এর মাঝে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। অবশ্যই আমরা আমাদের বাসার বুয়াদেরকে মানবিক সম্মান দেখাই, এবং তাদেরকে যথেষ্ট সমাদর করেই চলি কিন্তু যখন সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর শিশুটি অশিক্ষিত একটি বুয়ার কাছ থেকে জীবনের পাঠ নেয় তখন তার আচরণে কেন আমরা অসন্তুষ্ট হবো? সন্তান অনির্ভর যোগ্য স্থান থেকে নানান শিক্ষা এবং আচরণ শিখছে সে বিষয়ে আমাদের খুব একটা উদ্বেগ একেবারেই নেই। যেন বেঁচে গেলাম। ডে কেয়ার তো মনেহয় যেন এক একটা কয়েদখানা। হয়তো শিশুটি বুঝতে পারছেনা তার নিজের পরাধীনতা সম্পর্কে কিংবা তার প্রকাশ করার জ্ঞান নেই। অথচ মায়ের বুকের উষ্ণতা বঞ্চিত সেই একই শিশুর বড় কালের আচরণে আমরা কষ্ট পাই। কেন? কিসের কষ্ট? যখন আমি আদর দিইনি তখন খেয়াল ছিলোনা, আর যখন আমার বুকে লাথি ছুড়ে দিচ্ছে তখনই ছেলে ভালো না—বেয়াদব!!

মনে করা হয় মায়ের এবং বাবার উভয়ের কর্মমুখী জীবনই হয়তো এর জন্য দায়ী, কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়। চাকুরী করে যাচ্ছে এমন অনেক সচেতন বাবা মা দেখেছি যারা তাদের সন্তানদেরকে সচেতন ভাবে গড়ে তুলছেন। অবশ্য সেই সাথে একটি বিষয়ও খেয়াল রাখা উচিৎ আমরা সম্পদের মোহে কর্মের মাঝে এতোটাই মগ্ন হয়ে যাই যে আমরা নিজেদের কাজে কর্মে নিজেদেরকে টাকা উঠানোর একটি এটি-এম মেশিনের সাথে খুব একটা ফারাক রাখিনা। ভুলে যাই—আসলে আমিও একজন মা, কিংবা বাবা।

ভুলে যাই এডাল্ট লাইফের ব্যস্ততায় একটি কোমল ভবিষ্যতের ভিত নির্মাণের কথা। নিজেদের সাথে নিজেদের এই বিশ্বাসঘাতকতা আরও কতকাল চলবে আমাদের? আমরা নিজেরাই নিজ হাতে গড়ে তুলি এক একটি প্রজন্ম, নিজেদের সাথে নিজেদের এই স্বার্থপরতা আর কতকাল চলবে?

পূর্বে প্রকাশিত

0 comments:

Post a Comment

 

© 2009 Islam And Computing । Science without Religion is Lame, Religion without Science is Blind | Design by: Islam And Computing

^Back to Top